
শারমীন সুলতানা মিতু:
জমিদারী স্বত্ব থেকে প্রজাস্বত্তে স্থানান্তরের ৭০ বছর পেরিয়ে গেলেও বন বিভাগের জায়গা জেলা প্রশাসন কর্তৃক বুঝিয়ে না দেয়া এবং বন ঘেষা জায়গা ব্যবহারের ক্ষেত্রে যৌথ ডিমারকেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত না করাটাই ভাওয়াল গড়ের প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুটি বিষয়ই গাজীপুর জেলা প্রশাসনের তৎপরতার উপর নির্ভরশীল। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এক্ষেত্রে যুগ যুগ ধরেই সীমাহীন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলছেন। তবে স্থানীয়রা বলছেন, জেলা প্রশাসন ইচ্ছাকৃত গাফিলতির মাধ্যমে মূলত: জবর দখলকারীদের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। প্রশাসনের এ দুটি ব্যর্থতাকে পুঁজি করেই প্রভাবশালীরা একের পর এক বনের জায়গায় যথেচ্ছা লুটে নিয়েছেন, বানিয়েছেন কারখানা গড়েছেন হাজারো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। কেউ কেউ শত একর বনভূমি কব্জায় নিয়ে খামার বাড়ি, পর্যটন রিসোর্ট পর্যন্ত গড়েছেন নির্দ্বিধায়।
অন্যদিকে বন ঘেষা পৈতৃক সম্পত্তির মালিক দাবিদারদের ডিমারকেশন সংক্রান্ত কয়েকশ’ আবেদন গাজীপুর জেলা প্রশাসনে পড়ে আছে। নিজ জায়গায় ঘর তোলার অনাপত্তিপত্র চেয়ে বন বিভাগে দাখিল করা আর্জির সংখ্যাও কম নয়। কিন্তু চাহিদা মাফিক ‘উৎকোচ’ না দেয়ায় ডিমারকেশন ও অনাপত্তিপত্র ভাগ্যে জুটছে না। ফলে বন এলাকায় নিজস্ব জমি থাকা যেন অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নানারকম জটিলতায় কয়েক হাজার বাসিন্দার ভোগান্তি দেখারও কেউ নেই। তবে সব মহলকে ম্যানেজ করে বনভূমি দখলকারীদের এ ধরনের কোনো ঝক্কি ঝামেলায় পড়তে হয় না।
ডিমারকেশন ছাড়া বনভূমির একাংশ দখল করে একের পর এক বাড়িঘর, শিল্প কারখানা, হাটবাজার, দোকানপাট, নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার দৌরাত্ম্য কোনভাবেই থামানো যাচ্ছে না। ভাওয়াল রেঞ্জের ভবানীপুর বিটের শিরিরচালা এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে ডিমারকেশন এবং অনাপত্তিপত্র ছাড়াই কারখানার স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। ফলে মূল্যবান বনভূমি বেহাত হচ্ছে, ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশ ও প্রতিবেশের। বাঘের বাজার থেকে বিট অফিস রোড হয়ে কিছুদূর উত্তরে ট্রিমকো গ্রুপের লেবেল ফ্যাক্টরি। কারখানার পশ্চিম ও উত্তর পাশ ঘেঁষে সিএস ২৫৯ নং দাগের গেজেটভুক্ত বনভূমি। কারখানা কর্তৃপক্ষ জেলা প্রশাসন ও বন বিভাগের সাথে যৌথ ডিমারকেশন ছাড়াই উঁচু বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণ সম্পন্ন করে। কয়েক মাস ধরে উত্তর পাশে নতুন বড় ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। কারখানা স্থাপন সংক্রান্ত বন বিভাগের অনাপত্তিও নেওয়া হয়নি। কারখানাটির পশ্চিম পাশ দিয়ে বাউন্ডারি ওয়াল ২০০ ফুটের বেশি ও উত্তর পাশে প্রায় ১৫০ ফুট। উভয় পাশের বাউন্ডারি ওয়ালের ভেতরে কিছু বনভূমি থাকার অভিযোগ রয়েছে।
বনের মধ্যেই জোত-জমি
গাজীপুরের ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানটি ১৯৮২ সালে গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে সরকার সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করেন। গজারিগড় বেষ্টিত আড়াইশ প্রসাদ, ভবানীপুর, বাড়ইপাড়া, ডগুরী, বন খরিয়া, বাওপাড়া, উত্তর সালনা, বাহাদুরপুর মৌজার ৬৫ হাজার ৩৮৫ একর জমিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের আওতায় আনা হয়। এসব সংরক্ষিত বনাঞ্চলে রয়েছে হরেক রকমের গাছ-গাছড়া আর নানা ধরনের প্রাণী। তবে বনের ভেতরে স্থানীয় অধিবাসীদের জোত-জমি থাকায় তারা অবাধে বনে প্রবেশ করছে। আর এই সুযোগে বিভিন্ন কলকারখানার মালিক কৃষকদের কাছ থেকে জমি কিনে মিল কারখানা স্থাপনের নামে অবাধে বনের জমি দখল করে নিচ্ছেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, বন বিভাগের কর্মকর্তাদের গোচরেই কলকারখানার মালিক ও প্রভাবশালীরা সংরক্ষিত বনাঞ্চলের জমি গ্রাস করছে। প্রভাবশালীদের হাত থেকে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের জমি রক্ষা করতে না পারলে একদিন ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের গাছসহ জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা এখানকার বাসিন্দাদের।
বনভূমিতেই জমজমাট মার্কেট!
প্রথমে বনভূমি দখল, পরে দোকান নির্মাণ করে ভাড়া আদায়। এক পর্যায়ে গড়ে উঠল বড় আকারের জমজমাট মার্কেট। রাজেন্দ্রপুর রেঞ্জের রাজেন্দ্রপুর পূর্ব বিটের ধলাদিয়া এলাকার চিত্র এটি। সেখানে কয়েক বছর ধরে অবাধে চলছে এই বাণিজ্য।
ঢাকা-কাপাসিয়া সড়কের ডার্ড কম্পোজিটের পূর্ব পাশে গ্লোব মোজা কারখানা। কারখানাটির দক্ষিণ পাশে সংরক্ষিত বনভূমির মধ্য দিয়েই মোজা ফ্যাক্টরি রোড হয়েছে। রাস্তা সামনে রেখে উভয়পাশের সংরক্ষিত বনভূমিতে অন্তত ৩০টি পাকা টিনশেড দোকান গড়ে উঠেছে। পাঁয়তারা চলছে আরও দোকান নির্মাণের। দখলদারদের মধ্যে অন্যতম শ্রীপুরের নোয়াগাঁও এলাকার ওয়াজ উদ্দিনের ছেলে ইমরান হোসেন। রাস্তার পশ্চিম পাশে তার দখলীয় বনভূমির পরিমাণ প্রায় তিন গন্ডা। তাতে সাতটি দোকান নির্মাণ করে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। ইমরান বালু ফেলে আরও কয়েক শতাংশ বনভূমি দখলের চেষ্টা চালাচ্ছেন।
রাস্তার পূর্ব পাশে মোস্তফা কামাল, আবদুল খালেক, জামাল হোসেন ও আনেছা বেগমসহ ছয়জন দোকান নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছেন। তাদের দখলীয় বনভূমির পরিমাণ প্রায় আধা বিঘা। স্থানীয়রা জানান, একেকটা দোকানের ভাড়া মাসে দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা। জামানত ৫০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত। আশপাশে বনের জমি দখল করে বাসা ভাড়ার ব্যবসাও চলছে। তারা আরও জানান, ওই স্থানে বর্তমানে বিঘাপ্রতি জমির বাজারমূল্য দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা। এদিকে রাস্তার পশ্চিম পাশে নতুন সৃজিত আকাশমনি বাগান সংলগ্ন বনভূমি দখল করে একটি হোটেল করেছেন নজরুল ইসলাম। চার-পাঁচ মাস আগে হোটেলটি করা হলেও বিট অফিস কোন ব্যবস্থা নেয়নি। একজন ব্যবসায়ী বলেন, নজরুল বিট অফিসের সাথে কথা বলে লাখ টাকা লেনদেনের পরই হোটেল করতে পেরেছেন।
বন কেটে পাকা রাস্তা!
গাজীপুরের কালিয়াকৈরে সংরক্ষিত আকাশমনি বাগানের গাছ কেটে প্লট বিক্রির পাকা রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। কালিয়াকৈর রেঞ্জের মৌচাক বিট এলাকার দক্ষিণ ভান্নারায় এ ঘটনা ঘটে। সরেজমিনে জানা যায়, বনফুল বাজারের পূর্ব দিক দিয়ে অল্প দূরে উর্মি নিটওয়্যার কারখানা। কারখানার উত্তর দিকে বৃহৎ আয়তনের সৃজিত আকাশমনি বাগান। আরো উত্তরে নিচু জমি কিনে প্লট বিক্রির ব্যবসায় নেমেছেন স্থানীয় দুলাল ও হুমায়ুনসহ চারজন। তারা প্রথমে বাগানের কিছু গাছ কেটে রাস্তা তৈরি করেন। সেই রাস্তা দিয়ে মাটি বহন করে জমি ভরাট করা হয়। পরে প্রকাশ্য দিবালোকে তারা ১০ ফুট প্রস্থবিশিষ্ট ১২০ ফুট দৈর্ঘ্যের রাস্তাটিতে ইট বিছিয়ে বালু দিয়ে ঢেকে দেন। এরপর লোকজন জমি দেখা শুরু করেন। গাছ কেটে ও ডিমারকেশন ছাড়াই কয়েক দিন ধরে মাটি ভরাটের কাজ চললেও বিট অফিস কিছুই করেনি।
এদিকে কিছুদিন আগে রাস্তাটির দক্ষিণ পাশে বাগান ঘেঁষে ফাউন্ডেশন দিয়ে বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করেছেন ব্যবসায়ী মোসলেম উদ্দিন। বাগানের ভেতরে ইট-বালু রাখায় গাছপালার ক্ষতি হচ্ছে। প্রতিবেশীরা জানান, মোসলেম উদ্দিন ডিমারকেশন করেননি। গাছপালার ক্ষতি হলেও বিট অফিস কোন ব্যবস্থা নেয়নি। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, বনের লোকদের সাথে লাখ লাখ টাকা লেনদেন করার পরই কেবল গাছ কাটা, ডিমারকেশন ছাড়া মাটি ভরাট, স্থাপনা নির্মাণ করা সম্ভব হয়। টাকা ছাড়া কেউ কিছু করলে ভাঙচুর ও মামলা দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে দুলাল মিয়া ও মোসলেম উদ্দিনের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কাউকে পাওয়া যায়নি। রেঞ্জ কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা আশরাফুল আলম দোলনকে বিষয়টি জানালে তিনি বিট কর্মকর্তার সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন। বিট কর্মকর্তা শহীদুল আলম বলেন, আমি নতুন এসেছি। এখন সেটেলমেন্ট রেকর্ডের ব্যস্ততায় আছি। ইট থাকলে তুলে নিয়ে আসব, গাছ কাটা পেলে মামলা দিব।
আরো যতো বাণিজ্য
গাজীপুরে রাজেন্দ্র ইকো রিসোর্ট সম্প্রসারণে সংরক্ষিত বনভূমি দখল ও গাছ কাটা হচ্ছে। বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের অধীন ভাওয়াল রেঞ্জের বারুইপাড়া বিট এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশ্যে এ ঘটনা ঘটছে। সরেজমিনে জানা যায়, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ভবানীপুর বাজার থেকে পূর্ব দিকে গ্রিনটেক রিসোর্ট পেরিয়ে বনের গহীনে বিলাসবহুল রাজেন্দ্র ইকো রিসোর্ট লিমিটেড। রিসোর্টের পশ্চিম পাশে গত ২০২১ সালে নতুন স্পটের কার্যক্রম শুরু হয়।
‘সিলভার রেইন’ নামের এই স্পটের চারপাশে সংরক্ষিত গজারি বন। সেখানে এরই মধ্যে বনভূমি দখল করে, গাছপালা কেটে নির্মান হয়েছে তিনটি সংযোগ রাস্তা। ভেতরে ঢুকে কটেজে যাওয়ার রাস্তাও বন ঘেঁষে। রাস্তাটি নির্মাণের সময় কাটা হয়েছে বেশ কিছু ডালপালা। সেখানকার বাউন্ডারি ওয়ালের কিছু অংশও বনে পড়েছে। এদিকে মূল রিসোর্টের পূর্ব পাশ দিয়ে সম্প্রসারণ কার্যক্রম চলছে। সেখানে বনের ভেতর দিয়ে নির্মাণ সামগ্রী পরিবহন করা হচ্ছে। হাঁটাচলার প্রায় এক কিলোমিটার সাধারণ পথটি পরিণত হচ্ছে ব্যবসায়িক রাস্তায়। বালুবাহী ট্রাকের ধাক্কায় ভেঙে যাচ্ছে গাছপালা। সম্প্রসারিত স্পটে বন ঘেঁষে হাঁটার জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে ওয়াক ওয়ে। চলছে বাউন্ডারি ওয়ালের কাজ।
বিন্দুবাড়ী রাস্তা সংলগ্ন বনভূমি দখল করে স্থানীয় প্রতাপশালীরা পেঁপে বাগান করেছেন। সেখানে বিভিন্ন প্রজাতির গাছও লাগানো হয়েছে। পিলার পুঁতে নেট দিয়ে বেড়া দেওয়া হয়েছে। কাপিলাতলী মৌজার ওই স্থানের জমির বর্তমান বাজারমূল্য বিঘাপ্রতি ৫০ লাখ টাকা। বিন্দুবাড়ী মৌজার তিনটি স্পটে এ ধরনের দখলীয় জমির মূল্য ১০/১২ কোটি টাকা। জানতে চাইলে রাজেন্দ্রপুর পূর্ব বিট কর্মকর্তা বলেন, ব্যস্ততার কারণে সময় পাই না, আমি গিয়ে সব ভেঙ্গে চূরে বাগান করব। আর শ্রীপুর সদর বিট কর্মকর্তা মীর বজলুর রহমান বলেন, এসব দখল আগে হয়েছে। নতুন করে কিছু করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভাওয়াল রেঞ্জের বারুই পাড়া বিট এলাকায় বনের জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে ভাওয়াল গড় ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন সরকারের সাহেব বাড়ি রিসোর্ট গড়ে উঠেছে।
বারুই পাড়া বিট কর্মকর্তা আবুল কালামের সাথে আমাদের প্রতিবেদক মুঠোফোনে যোগাযোগ করে সাহেব বাড়ি রিসোর্ট বনের জমি দখল করে আছে সে সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন সাহেব বাড়ি রিসোর্টে আমাদের বনের কোন জমি নাই, আমার আগের কর্মকর্তা কিছু লিখে রেখে যায় নাই।
সাহেব বাড়ি রিসোর্টের জমি ডিমারকেশন করা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন হ্যা অবশ্যই আছে।
আপনার যদি আরো কোন তথ্য জানতে হয় তাহলে আমার অফিসে এসে জেনে যাবেন।।